কুড়ি পেরােলেই বুড়ি, মেয়েদের সম্বন্ধে এরকম একটা কথা চালু আছে বটে, কিন্তু কুড়ি দুগুণে চল্লিশ পেরিয়েও বন্যা যদি নিজেকে বুড়ি মনে করতে না পারে, তার জন্যে দোষটা সম্পূর্ণ ওকে দেওয়া যায় না। বাবাকে বন্যা দেখে এসেছে জন্মগত-রােম্যান্টিক। এই ক’বছর আগেও যখন গিয়ে থেকেছিল ক’দিন বাপের বাড়িতে, মায়ের কাছে শােবার আর্জি পাশ করাতে পারেনি।
বাবা বলেছে, সারাদিন যত খুশি হাম্বা হাম্বা কর, রাত্তির
বেলা আমাদের অনেক নিজস্ব গল্প থাকে, তখন আমাদের ডিস্টার্ব করবে না। মা মুখে বলেছে বটে ভীমরতি' কিন্তু বুঝিয়ে দিয়েছে এতে মায়েরও বিশেষ আপত্তি নেই। মেয়েকে রােম্যান্টিক করেই গড়ে তুলতে চেয়েছিল বাবা।
নিজেও বই পড়ত প্রচুর, মেয়ের ওপরও বই পড়বার ব্যাপারে কোনাে বিধিনিষেধ ছিল না। শেষের কবিতা ছিল বাবার সবচেয়ে প্রিয় বই, তাই মেয়ের নাম রাখতে চেয়ে ছিল লাবণ্য কিন্তু কমন হয়ে যাবে বলে, বন্যা। ইচ্ছে ছিল স্বামী হিসাবে একটা অমিতকে খুঁজে বার করবে, কিন্তু পারেনি। জামাইয়ের নাম রাহুল, কিন্তু সে কবি পত্র-পত্রিকায় তার কবিতা প্রকাশিত হয়, বিয়ের আগেই একটা কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিল, যদিও পেশায় সে ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিরক্ষা বিভাগের অ্যাকাউন্ট্যান্ট। বাবার বদান্যতায় বন্যা বিদ্যালয়ে থাকতেই ব্যোমকেশ বাদে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বইপত্তর শেষ করে ফেলেছিল। কলেজে পড়বার সময় শেষের কবিতা পড়ত বাবা আর ও দুজনে মিলে। বিয়ের পর সর্বসমক্ষে বরকে যে সম্বােধনই করুক, অন্তরঙ্গতার
সময় ডাকত ‘মিতে’ বলে। ভারী অদ্ভুত দাম্পত্য সম্পর্ক তৈরি করেছিল ওরা। রাহুল ওকে পড়িয়েছিল মুজতবা আলির ‘শবনম্', সেই উপন্যাসের একটা প্রিয় কথা শুনিয়েছিল ওকে- -“তুমি আমার মিলনে অভ্যস্ত হয়ে যেয়াে না, বিরহেও অভ্যস্ত হয়ে যেয়াে না।” অর্থাৎ অভ্যস্ত ব্যাপারটাই থাকা চলবে না।
কী করে সেটা হবে? ঠাট্টা করেই বলেছিল বােধহয়, ‘পরকীয়া!
আহা পরকীয়া না থাকলে দাম্পত্য জমে!
‘সে কী!
‘তােমার কাউকে ভালাে লাগলে তার সঙ্গে আলাপ করবে, আমার কাউকে ভালাে লাগলে আমিও তার সঙ্গে আলাপ করব।”
“আমি তাে জানতে পারলেই তার সঙ্গে চুলােচুলি করব, অবশ্য তােমাকেও ছেড়ে দেব না।
‘আমিও তাই। তুমি অন্য কারাে সঙ্গে মিশছ, সেটা কি আমি সহ্য করতে পারব?
ঝগড়া করব আমিও।
“মধুর দাম্পত্য। ঝগড়ঝাটি, মান-অভিমান ছাড়া দাম্পত্য জমে! আর এসবের জন্যেই তাে চাই পরকীয়া। এসব অবশ্য দাম্পত্য আলাপেরই অঙ্গ। বউ হয়ে রাহুলের সংসারে যখন এল বন্যা, তখন এই ঘনিষ্ঠতার সুযােগ ছিল। সংসার অবশ্য বিরাট, এমনিতে এক ছেলে এক মেয়ে, মেয়ে সুজাতার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল স্বাভাবিকভাবেই।
শাশুড়ির বউপ্রীতিও ছিল স্বাভাবিক রকমেরই অফিস থেকে ছেলে ফিরে না আসা পর্যন্ত যথেষ্ট সান্নিধ্য দিতেন, ছেলে ফিরূলেই তার অন্যত্র ব্যস্ততা বেড়ে যেত। শ্বশুর গােটাকতক খবরের কাগজ নিতেন, সন্ধেবেলা খুঁটিয়ে কাগজ পড়া ছিল তাঁর হবি। সংসার বড়াে ছিল এই জন্যে যে সেখানে আরাে দুজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যা ছিলেন, তারা দুই আইবুড়াে পিসি বকুল এবং ঝর্ণা, সংক্ষেপে বকা পিসি, ঝকা পিসি। দুজনেই অধ্যাপিকা, তাদের আলাদা ঘর ছিল এবং তাঁরা নিজেদের পড়াশুনাের বাইরে অন্য কথাবার্তা বলা বিশেষ পছন্দ করতেন না। এটা ছিল বন্যা যখন সবে কুড়ি পেরিয়ে সংসারে এসেছে, তখনকার কথা। কুড়ি বছর পরে ছবিটা গেছে একেবারে পালটে। না, শ্বশুর শাশুড়িকে নিয়ে কোনাে সমস্যা নেই শাশুড়ি বছর ছ-সাত আগে দেহান্তরিত হয়েছেন। তারপর শ্বশুরের কথাবার্তা আরাে অনেক কমে গিয়েছে, তিনি দিনের বেশিরভাগ সময়ই ক্রসওয়ার্ড পাজল নিয়ে ব্যস্ত থাকেন এবং বিকেলে এক বাল্যবন্ধু এলে একটু বেড়ান বা গল্পস্বল্প করেন। সংসারে সদস্য-সংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে। পিঠোপিঠি দুই ছেলে অরুণ-বরুণ, একজন ক্লাস থ্রি, অন্যজন ফোর।
দিব্যি আছে দু'ভাই, তাদের আলাদা ঘর আছে, ভিডিও খেলা আছে, প্রাইভেট মাস্টারমশাই আছে। সুতরাং মা-বাবাকে ভালােবাসে খুবই কিন্তু সর্বক্ষণ গায়ে সেঁটে থাকার ন্যাকামি নেই।
সমস্যা দেখা দিয়েছে অন্য জায়গায়। যে-কোনাে কারণেই হােক সুজাতাদের সন্তানাদি হয়নি। এই কারণেও তার শ্বশুরবাড়ি তার প্রতি খুব প্রসন্ন ছিল না, তার ওপর বছর পাঁচেক আগে অকস্মাৎ পথ-দুর্ঘটনায় তার স্বামী মারা যাওয়ায় ‘অলক্ষুণে’ বউয়ের প্রতি নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকে। সহ্যের বাইরে চলে যাওয়ায় রাহুল তাকে নিয়ে এসেছে নিজের কাছে। অসহায়া ননদটির প্রতি বন্যার সহানুভূতির কোনাে অভাব নেই, কিন্তু বৌদির ছায়াসঙ্গিনী হয়ে পড়বে, এতটাও সে চায়নি।
তবু হয়তাে রাহুলের অফিস থেকে ফিরে আসবার পরে খানিকটা সময় ননদকে একটু ম্যানেজ করে অন্য কোনাে কাজে ব্যাপৃত রাখা যেত, কিন্তু মূর্তিময়ী অসুবিধা হয়ে দেখা দিয়েছেন বিদুষী দুই পিশাশুড়ি, বকা এবং ঝকা। কলেজ থেকে তারা রিটায়ার করেছেন বছরখানেক হল।
কলেজে পড়ার সময় লেখাপড়ার প্রতি যে-পরিমাণ উৎসাহী ছিলেন, সাংসারিক ব্যাপারে ততটাই ছিলেন উদাসীন। অবসর নেবার পর চিত্রটা পুরােপুরি
পালটে গেছে, লেখাপড়ার ধার-কাছ দিয়ে যান না দেখলে মনেই হবে না পড়াশুনাের সঙ্গে কস্মিন কালেও কোনাে সম্পর্ক ছিল তাদের। বদলে বন্যাকে সংসার সম্বন্ধে সেয়ানা করবার জন্যে এমন উঠে পড়ে লেগেছেন যে বন্যার প্রাণ ওষ্ঠাগত। রাহুলের তাড়া থাকে সকালে বেরােবার সময়, কাজেই ফিরে যখন আসে, ঝাপিয়ে পড়েন দুজন একসঙ্গে কারণ স্বামী-স্ত্রীকে এক জায়গায় পেলে কথামৃত শােনাবার সুবিধে হয়। মাসছয়েক ধরে বােঝাবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন, অরুণ-বরুণকে রাহুল নিজেই যেন অফিস থেকে ফিরে একটু নিয়ে বসে, কারণ প্রাইভেট মাস্টারমশাইকে দিয়ে ওসব কাজ হয় না। রাহুল বলবার চেষ্টা করেছিল, আপনারা দুই বিদুষী অধ্যাপিকা থাকতে কিনা আমি- অর্থাৎ এক ঢিলে দুই পাখি মারার চেষ্টা। সেটা সঙ্গে সঙ্গে উড়িয়ে দিয়ে বকা-ঝকা পিসিমা বলেছেন, ‘অসম্ভব! পড়াশুনাের মধ্যে আমরা আর নেই। তাছাড়া বাবা ইজ বাবা, এসব ব্যাপারে বাবার কোনাে বিকল্প নেই।
ক্রমাগত বাস্তবের ধাক্কা খেয়ে রােমান্স যখন কলেপড়া ইদুরের মতাে চেপটে গেছে, ক্লান্ত এবং বিধ্বস্ত বন্যা করুণ চোখে চেয়েছিল রাহুলের দিকে, বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর। চাউনির অর্থ বুঝে রাহুল বলেছে, বাঁচতে গেলে মরতে হবে, এ ছাড়া কোনাে উপায় নেই।
‘কিছুই বুঝলাম না।
‘সহজ কথা, আমার অফিসে কাজের চাপ পড়ে যাবে, ফিরতে অনেক দেরি হয়ে যাবে আমার রােজ।
‘তাতে আমার কী সুবিধে হল ?
‘তােমারও কেনাকাটার ব্যাপার থাকবে, সন্ধে ছাড়া সময় কোথায় ?
‘ইল্লি। সংসার সম্বন্ধে দুজন জ্ঞানদায়িনীকে এড়িয়ে আমি বেরিয়ে পড়বাে? যদিই বা পড়ি, ননদিনী রায়বাঘিনীকে ছেটে ফেলবাে কী করে!
‘তাহলে আমাদের সম্পর্ক ভালাে করার একটাই উপায়।
‘বলে ফেলতে আজ্ঞা হােক।
‘সম্পর্কটাকে খুব খারাপ করে ফেলা।
‘আবার হেঁয়ালি করছাে মিতা?
‘হেঁয়ালি নয় বন্যা, সংসারে প্রবেশ করার সময় একবার বলেছিলাম, উপহাস বলে মনে করেছিলে। সেটা ছিল আসলে নির্মম সত্য।
“কী সেটা?
‘পরকীয়া। প্রথম যৌবনে পালন করতে পারনি, শেষ যৌবনে পালন করাে, শান্তি পাবে।”
তােমার সুবিধে আছে গুঁতিয়ে বেড়া ভাঙার, তুমি ছাড়া-গােরু। আমার ইচ্ছে থাকলেও দ্বিচারিণী হবার সুযােগ নেই, আমি বাঁধা গরু।
‘কোন কালে বাস করছাে তুমি! কম্পিউটার আছে, চ্যাটিং আছে, দূরভাষ যন্ত্র আছে-স্বেচ্ছাচারী হতে গেলেই বেড়া ভাঙতে হবে নাকি?”
‘বলছ! পরে সামলাতে পারবে তাে?
‘পরপুরুষকে, না পরস্ত্রীকে?
‘জোরটা যদি নিজেদের থাকে তাহলে পারবো’ রাহুল বলেছে, চেষ্টা করে যাও প্রাণপণে, আমি বলছি সুফল ফলবে।
‘মানে ঘর ভাঙার, না ঘর জোড়ার?
‘অবশ্যই পরেরটা। ব্যভিচার না করলে মানুষকে কেউ মানুষ বলেই গণ্য করে না- আমি একটা দুগ্ধপােষ্য স্বামী এবং তুমি সাধ্বী স্ত্রী। গণ্ডগােলটা হয়ে গেলেই দেখবে আমার জ্ঞানদায়িনী পিসিরা আমাকে সমঝে চলছেন, বেশি ধারে-কাছে আসছেন না।
“আর আমি?
‘তুমি তখন আর ললিত লবঙ্গলতা বৌমা নও, বন্যা নামের এক বিদ্রোহিনী নারী।
এতক্ষণ গল্পের যেটুকু বলা গেল সেটা হল মূল গল্পের প্রস্তাবনা মাত্র। গল্পটা শুরু হবে এইবার।
সন্ধে হয়ে গিয়েছে। শ্বশুরকে এবং দুই পিসি শাশুড়িকে চা দিয়ে এসেছে বন্যা। ননদ ঠাকুরঘরে সন্ধে দিতে গেছে। বকা পিসি চায়ের কাপ হাতে বন্যার ঘরের দিকে ঢুকছিল, ‘রাহুল তাে আজকাল নটা-দশটার আগে ফেরেই না, কী যে এত রাজ্যের কাজ তা বুঝি না, তােমাকেই কথাটা বলি বৌমা, সময় করে বন্যার ঘরে ঢুকে ভুরু কুঁচকে উঠল পিসিরা। বন্যা ফোন করছে কাউকে, হাসি হাসি মুখে কথা বলছে। এতই মগ্ন যে পিসির আগমন পর্যন্ত টের পায়নি। বলেই চলেছে, ‘তবু ভালাে ফোন করলে। কোনােদিন যে পরিচয় ছিল আমার সঙ্গে, সে তো ভুলেই গিয়েছিলে! যাক গে, আসল কথা বলাে “বৌমা!’ বকা পিসি বন্যার দিকে চেয়ে বললেন, ‘কে ফোন করছে?
‘বাবা, বলাে কী, দুই ছেলেও হয়ে গিয়েছে! হায় রে, আমি ভারী বুঝি আমার কথা ভেবে ভেবে তােমার ঘুম হয় না। তা, বউয়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবে না?
‘বৌমা!’ অধ্যাপিকা ভঙ্গিমায় গলা চড়িয়ে ডাকলেন পিসি, আমি একটা কথা জিগগেস করছি তােমায়!
ফোনের মুখটা চেপে ধরে এদিকে চেয়ে বন্যা বললে, ‘ফোন করতে করতে কথার জবাব দেওয়া যায় না পিসিমা। যা জিগগেস করার পরে করবেন। ফের ফোনের মুখ থেকে হাত সরিয়ে বলল, “হ্যা, যা বলছিলাম, কবে আসছাে বলাে বউকে নিয়ে। আরে
শ্বশুরবাড়ি তাে কী হয়েছে, আমার শ্বশুরবাড়ি খুব কনসিডারেট, দুই পিসশাশুড়ি ডাকসাইটে অধ্যাপিকা ছিলেন। চলে এসাে, চলে এসাে।
‘হুঁ! জুতাে মেরে গােরু দান’– দাঁত কিড়মিড় করতে করতে ঘরে গেলেন বকা পিসি।
তা গেলেন, কিন্তু দৃশ্যটা ভুলতে পারলেন না কিছুতেই। সুযােগ পেলেই চেপে ধরবেন বৌমাকে, মনে মনে স্থির করে রাখলেন। কিন্তু সুযােগটা পাবার আগেই ঝর্ণা পিসির কপালেও সেই একই অভিজ্ঞতা জুটল। বলতে যাচ্ছিলেন, কাচাকাচি কাজের মেয়ে খুব কম করে করছে বােধহয়, সময়মতাে কাচা শায়া-ব্লাউজ পাচ্ছেন না তিনি, কিন্তু বলতে গিয়ে দেখলেন, যাকে বলবেন সে নিজের ঘরে ফোন ধরে প্রায় গড়িয়ে পড়ছে হেসে।
“বাবা, বলাে কী! তােমার পেটে পেটে এত! আগে যখন কথা বলতে তখন তাে। একেবারে নিপাট ভালােমানুষ, ভাজা মাছটি উলটে খেতে পারাে না। আর এখন বলছো, আমার মতাে মহিলা তুমি জীবনে দেখােনি।
তােমার বউকে বলতেই হচ্ছে ফোন করে।
কী বললে, উঁহু, ঘুষ চাই, এমনিতে হবে না....সত্যি, পারােও বটে তুমি ! কিছুই কি আটকায় না তােমার মুখে? না না, ফোন করাে, আমার ভালাে লাগে। কথাগুলাে তােমার আগের মতােই রয়েছে..আরে আমি কি ইচ্ছে করলেই পারি নাকি ফোন করতে? বাড়ির বউ বলে কথা, অত স্বাধীনতা কি আছে নাকি আমার!
‘কমও তাে কিছু দেখছি না’- ফিস ফিস করে বলতে বলতে সরে গেলেন ঝকা পিসি। দিদির চোখে পড়েছে একদিন, একটু সাবধানে কথা বলাে এটাই শিক্ষা দিতে এসেছিলেন ভাইপাের বউকে, এসে যা দেখলেন তাতে তাে বাকরুদ্ধ হয়ে যাবারই কথা, বলবেন কী তাকে! দেখেশুনে নিজেদেরই তাে আক্কেল গুড়ুম। বৌমা এমনিতে বেশ চলিয়ে-বলিয়ে হলেও স্বভাব-চরিত্রে যে এরকম গােলমাল আছে সেটা তাে আগে কখনাে বােঝেননি। অবশ্য নিজের বরের সঙ্গেই যে ওইভাবে ঢলেপড়া ভঙ্গিতে কথা বলে আগে আগে চোখে তাে পড়েছে অনেক, তার চালচলন নিয়ে সন্দেহটা আগেই হওয়া উচিত ছিল।
কিন্তু বৌমা নীচে নেমেছে বলেই তারাও নিজেদের সম্মান বিসর্জন দেবেন, এ তাে আর হয় না। কার সঙ্গে বৌমা এত ফষ্টিনষ্টি করছে সেটা জিজ্ঞাসা করতেও তাদের রুচি হয় না, বরং সুজাতাকেই একদিন জানতে বলবেন কথাটা, এইরকম ঠিক করলেন।
মুশকিল হল, সুজাতাকে মুখ ফুটে কথাটা বলবার আগেই সুজাতা নিজেও এ ঘটনার সাক্ষী হয়ে পড়ল। অরুণ-বরুণ মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়তে বসার আগে দুধ দিয়ে কর্নফ্লেক্স খায়। দুধটা কেটে গেছে আজ, ওদের কী খেতে দেবে জিজ্ঞাসা করতে ঢুকেছিল বৌদির কাছে, গিয়ে দেখল হাসতে হাসতে বিছানায় গড়িয়ে পড়েছে বন্যা, বলছে, বলতে পারলে তুমি কথাটা? তুমি কী গাে, ঠাট্টা করেও কি এমন কথা বলতে আছে!
তােমার বউ শুনলে কী ভাববে!
এই দেখাে, আবার সেই প্রস্তাব!
আরে বাবা আমি একটা গৃহবধু, তােমার সঙ্গে সন্ধেবেলা আমি নাটক দেখতে যাবো?
স্বামী?
আমার স্বামী-দেবতাটি আজকাল রাত দশটার আগে বাড়িই ফিরছেন না, জানি না তিনি আবার
নতুন কোনাে প্রেরণার সন্ধান পেয়েছেন কিনা..., আঁ, না না বলেন তাে অফিসে কাজের খুব চাপ পড়েছে। কিন্তু এতক্ষণ পর্যন্ত কি অফিস খােলা থাকে! কী জানি বাপু।-এই, না না, দু-এক দিন অন্তরই ফোন করবে, লক্ষ্মীটি, তােমার এই ফোনটুকুর আশাতেই আমি থাকি সারাদিন।
কথা বলবে কী সুজাতা, পালাতে পারলে বাঁচে। দৌড়ে গিয়ে বললে পিসিদের, তােমরা একটা বিহিত করাে এবার, নইলে কিন্তু বৌদি একেবারে হাতের বাইরে যে চলে যাচ্ছে, এটা ওঁরাও বুঝতে পারছিলেন। কারণ ব্যাপারটা ক্রমশ প্রায় নিয়মিতই হতে চলেছে। প্রথম দিকে ছিল পাঁচ-সাত মিনিট, বাড়তে বাড়তে সেটা এখন কুড়ি-বাইশ মিনিটে দাঁড়িয়েছে। এদিকে সরল সাদাসিধে দেখতে হলে কী হয়, তালে ঠিক আছে শনি-রবি রাহুলের ছুটি, সে দুটো দিন কিন্তু ওই বে-আক্কেলে লম্পটের ফোন আসে না। বৌমাই বারণ করে দিয়েছে হয়তাে, নয়তাে সে দুশ্চরিত্র বজ্জাতটারও হয়তাে দুটো দিন ছুটি, বউয়ের কাছে পত্নীনিষ্ঠ সেজে বসে থাকে।
রােজই ক্লোজড ভাের কনফারেন্স চলে বকা-ঝকা পিসির। স্টেপ তাে একটা নেওয়াই উচিত কিন্তু সেটা ঠিক কী, সেটাই ঠিক করতে পারেন না। যে পর্যায়ে গেছে ব্যাপারটা, সুজাতাকে দিয়ে কিছু হবে না, বলতে ওঁদেরই হবে, এটা ঠিক। কিন্তু বলবেন কাকে!
বৌমা যেরকম গভীর জলের মাছ, উলটোপালটা কথা বলে যাহােক একটা কিছু বুঝিয়ে দেবে হয়তাে। সেক্ষেত্রে রাহুলকে বলতে পারলেই সত্যিকারের কিছু কাজ হবে হয়তাে। সবচেয়ে ভালাে হত কথাটা দাদার কানে তুলতে পারলে। কিন্তু দাদা সংসার থেকেই যেমন আলাদা হয়ে পড়েছেন, তিনি এ নিয়ে হয়তাে মাথাই ঘামাবেন না, হেসে উড়িয়েই হয়তাে দেবেন কথাটা। অথচ উড়িয়ে দেবার মতাে যে আর নেই কথাটা সেটা তাে বিলক্ষণ টের পাচ্ছেন তাঁরা।
বন্যাকেই কথাটা বলে ফেললেন একদিন দোনামনা করে। দুপুরে খাওয়ার টেবিলে, খাওয়া যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, দাদা উঠে গেছেন খেয়ে, বকুল পিসি বললেন, কত কথা থাকে সংসারের, সন্ধেবেলা তাে তােমাকে পাওয়াই যায় না।
‘আমাকে!’ অবাক হয়ে বললে বন্যা, ‘কেন, আমি তাে দিনরাত বাড়িতেই আছি।
না, ওই যে কে যেন সন্ধেবেলায় ফোন করে না রােজ! ও হ্যা, সত্যি পিসিমা, কী অদ্ভুত যে লােক না আর কী মজার মজার কথা বলে!
শুনলে আপনারা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়বেন।
“কে লােকটা? কতদিনের আলাপ?
‘অনেক দিনের। বিয়ের আগেই তাে আলাপ হয়েছিল। ‘তা এতদিন কোনাে যােগাযােগ ছিল না, আজই হঠাৎ ঘন ঘন ফোন করতে আরম্ভ “আরে সেইটাই বললাম আমি ওকে সেদিন! অ্যাদ্দিন তাে মনেই ছিল না আমার কথা-এই কুড়ি-একুশ বছর পরে কি তােমার ভালােবাসা উথলে উঠল নাকি!
ছি ছি, বৌমা “না পিসিমা, যা ভাবছেন তা নয়, বিয়ে-থাওয়ালা মানুষ, ছেলেপিলে আছে। আসলে
ওর কথা শুনতে আমার ভীষণ ভালাে লাগত, তাই ফোনটা এলে আমার ভারী মজা লাগে।
‘আসতে বলো বাড়িতে, আমরা সবাই মিলেই না হয় ওর কথা শুনবাে।” ‘বলিনি নাকি! সেদিকে ভারী সেয়ানা, বলে, তােমাদের বাড়ি গেলে তুমি কি আর কথা বলার সুযােগ পাবে, বাকি সবাই তখন গল্পগুজব করবেন আমার সঙ্গে।
তার মানে তােমার সঙ্গে গল্প করেই ও আনন্দ পায় !
‘তা ছাড়া আর কী। নইলে মাঝে মাঝেই এতক্ষণ ধরে ফোন, খরচাও তাে আছে, বলুন পিসিমা।”
কাটা ঘায়ে যেন নুনের ছিটে গিয়ে পড়ে। কী কথার ছিরি! বকুল পিসিমা বলেন, ‘তা এতই যখন বােঝ তখন একটু বারণ করতে পারো না বাপু ফোন করতে?
‘কষ্ট লাগে, সামান্য ফোন বই তাে নয়, বারণ করবাে!
এইভাবে সব কিছু স্বীকার করে নিলে তার বিরুদ্ধে বেশিক্ষণ জেহাদ চালানাে যায়!
রণে ভঙ্গ দিলেন পিসিরা, কিন্তু রাগ গেল না মন থেকে, বরং আগুনে ঘৃতাহুতি পড়ল বন্যার এই পিত্তি-পােড়ানাে কথা শুনে। সুতরাং আর বেশি দেরি না করে রাতে খাওয়ার সময় রাহুলকে একটু একা পেয়ে বকা পিসি যথেষ্ট উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন,
‘হ্যারে, কী কাণ্ড শুনেছিস?”
“কিসের কাণ্ড?
‘আরে সেই লােকটার কথা বলছিরে, রােজ রােজ যে উত্যক্ত করে ‘আঁ! লােকটা এসেছে নাকি!’ হকচকিয়ে তাকাল রাহুল, ‘কই আগে কিছু বলোনি
তাে? “না না আসবে কেন, ফোন করে তাে’ ‘ও, তাই বলাে!’ রাহুল খানিকটা ধাতস্থ হয়ে বলল, ‘করতে দাও তো ফোন! পাগলে কিনা বলে ছাগলে কিনা খায়। আমি যদি ঠিক থাকি তাে কে কী বলল না
বলল- “তাের কথা কে বলছে!
আমি বলছি- ‘হ্যা, ওর স্ত্রীর কথা তাে?
কী করবাে বল, দোষের মধ্যে ওর একটা ক্লেইম আমি কাগজপত্র ঘেঁটে উদ্ধার করে দিয়েছিলাম। অ্যাকাউন্টসে কাজ করি, এরকম টুকটাক
উপকার তাে করতেই হয় লােকের। ওর বউ একেবারে ভেবে বসেছে আমি সাক্ষাৎ ভগবান। প্রত্যেকদিন অফিস ছুটির সময় এসে বসে থাকবে আর নানা ছুতােনাতায় সে কি! তাের রােজ রােজ দেরি কি ওই জন্যেই হয় নাকি?”
বেশিরভাগ দিনই তাই হয়। হাজার হলেও মেয়েমানুষ বলে কথা, বেশি রূঢ় কথাবার্তাও তাে বলতে পারি না। বায়নাক্কা তাই দিন দিন বেড়েই চলেছে। মানে? “আরে, আজ রেস্টুরেন্টে বসাে, কাল আমাকে একটু এগিয়ে দাও, পরে একদিন বলে কি সিনেমা যাবে একসঙ্গে। আচ্ছা এরকম করলে ওর বর রাগ করবে না?
‘তুই অ্যালাউ করিস এসব?
মেয়েটাকে সােজা হটিয়ে দিতে পারিস না?'
“কী করি বলাে, হাজার হলেও ভদ্রঘরের মেয়ে--
‘ভদ্র না কচু! ওরা ডাইনি, শাকচুন্নি ওরা ভ্যামপায়ার! পুরুষ মানুষের রক্ত চুষে খেতেই ওদের আনন্দ। ছি ছি ছি খােকা, তুই শেষ পর্যন্ত এইরকম ডাইনির ফাদে পা দিলি!'
‘ওর বরটাও তাে আমাকে শাসায়! সেই জন্যেই ভাবলাম, সে বােধহয় বাড়ির ঠিকানা পেয়েছে বাড়িতে এসে হামলা করছে।
এরপরও আর শােনা যায়! কত অধঃপতন মানুষের হতে পারে। জ্বলে-পুড়ে মরছিলেন। বৌমাটিকে নিয়ে, এ যে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে গেল—একসঙ্গে দু-দুটি ব্যভিচার ! একান্ত নিজের মানুষ দুজনেই, স্বপ্নেও কি ভাবতে পেরেছিলেন এত অধঃপতন হতে পারে দুজনের!
কোনাে উপায় ছিল না দাদার কাছে না গিয়ে। দুপুরে যখন বিশ্রাম করছিলেন পরের দিন, চুপি চুপি হানা দিলেন দু’বােন তার কাছে, বললেন, তােমাকে বিরক্ত করার কোনাে ইচ্ছে ছিল না দাদা আমাদের। কিন্তু শুনলেই বুঝতে পারবে, এ ছাড়া আর কিছু করবারও নেই আমাদের।
‘কেন, এমন কী হল?
‘কী হল না তাই জিজ্ঞাসা কর। রাহুল আর বৌমা দুজনেই একেবারে গােল্লায় গেছে।
‘মানে তােমাকে খুলে বলতে পারবাে না, এটুকু শুধু জেনে রাখাে রাহুল একটা মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে-
রাহুল! অসম্ভব! আমি বিশ্বাস করি না।
‘বিশ্বাস কি আর আমরাই করেছি! বিশেষ করে সে মেয়ে আবার দু’ছেলের মা, তার স্বামী রােজ চোখ রাঙাচ্ছে খােকাকে-
‘কী বলছিস বকা ! আর বৌমা ?
‘লীলাখেলায় তিনিও পিছিয়ে নেই, প্রত্যেকদিন সন্ধেবেলা এক মিনসের সঙ্গে ঝাড়া আধঘণ্টা প্রেমপর্ব চলছে।
‘বৌমা।
“হ্যা গাে, তােমার আদরের বৌমা।
বিশ্বাস না করাে-
‘করি না বিশ্বাস।
কালই আমি এর হেস্তনেস্ত করবাে।
সন্ধেবেলা সে ব্যাটার ফোন এলেই তােরা আমায় খবর দিবি।
Full Story Click Here
Orginal Story Click Here